রেহানার কাছ থেকে রেহাই মিলত না কোনো ব্যাংকের

Daily Inqilab অনলাইন ডেস্ক

১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৫ পিএম | আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৪ পিএম

শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা। আওয়ামী লীগ বা সরকারের নেতৃত্বভাগে সরাসরি তাকে দেখা না গেলেও বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে ‘বিশেষ ভূমিকা’ পালন করতেন তিনি।

 

দলটির সদস্যরা তাকে ডাকেন ‘ছোট আপা’ বলে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতা ছেড়ে পালান, সঙ্গে পালান তার ছোট বোন শেখ রেহানাও।

 

আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত হওয়ার পর থেকে নানা সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনার বিরুদ্ধে বড় কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে গণমাধ্যমে। অভিযোগ মিলছে ‘ছোট আপা’ রেহানার বিরুদ্ধেও। যেন তেন জায়গার নয়, তার দুর্নীতির অভিযোগ সরাসরি দেশের অর্থনীতির ভিত্তিতে অর্থাৎ, ব্যাংকে।

 

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে থাবা বসিয়েছিলেন শেখ রেহানা। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ হতো তারই পরামর্শে। শেখ হাসিনাও বোনের সুপারিশ পেলে ব্যাংকগুলোর নীতিনির্ধারণী পদে নিয়োগ দিতেন। অভিযোগ উঠেছে, ব্যাংকগুলোর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মহাব্যবস্থাপক পদের নিয়োগেও কলকাঠি নাড়তেন রেহানা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা এসব পদে বসতেন, তাদের অবশ্যই তার ‘আশীর্বাদ’ নিতে হতো।

 

দেশের ব্যাংকিং খাতে কেলেঙ্কারিতে জড়িত এক নাম শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক লুটের প্রধান হোতা। ২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী তিনটি বছর বেসিক ব্যাংককে তিলে তিলে শেষ করলেও বাচ্চু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। খোদ সরকারের মধ্যেই এ নিয়ে অস্বস্তি থাকলেও জানা যায়, শেখ রেহানার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কারণেই তাকে কেউ স্পর্শ করার সাহস পাননি।

 

ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৯টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ফখরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে এমন অপরাধ করলেও মাথার ওপর রেহানার হাত থাকায় কোনো মামলায় শেখ আবদুল হাই বাচ্চু আসামি ছিলেন না।

 

বাচ্চু ছাড়াও দুই ‘বিগফিশ’ সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে শেষ করে দেওয়ার বড় তদারক। শেখ রেহানার পক্ষে তারাই ব্যাংকগুলোয় অনিয়ম করিয়েছেন সমানতালে। অভিযোগ উঠেছে, সালমান ও নাফিজের মাধ্যমে ব্যাংকের বড় পদধারী হতে ইচ্ছুকরা লবিং করতেন। কোনো কোনো সময় এদের দুজনের একজন আবার কোনো সময় দুজনের সম্মতিতে নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হতো। তারা যাচাই-বাছাই করে নাম-পরিচয় পাঠাতেন শেখ রেহানার কাছে। তিনি আবার বড় বোন শেখ হাসিনার কাছে সুপারিশ পাঠাতেন। সেটির পরিপ্রেক্ষিতে বেসিক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান-এমডি নিয়োগের চূড়ান্ত অনুমোদন দিতেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা।

 

অভিযোগ রয়েছে, এসব নিয়োগ কোনোটিই ‘ফ্রি ফান্ডে’ হতো না। দিতে হতো মোটা অংকের ঘুষ। সালমান এফ রহমান বা চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের কাছে এসব ঘুষ আসতো ব্যাংকের মাধ্যমেই। নাম প্রকাশ না করা ব্যাংকের বড় পদের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যাদের নিয়োগ নিয়ে হাসিনার সঙ্গে রেহানার সুপারিশ চালাচালি হতো, তাদের ঘুষ নিতেন সালমান ও নাফিজ। প্রার্থীদের পক্ষে অনেক সময় ঘুষের টাকা পরিশোধ করতো বড় ঋণগ্রহীতা বা করপোরেট গ্রুপ। বড় পদের জন্য থাকতো বড় শর্তও। যেমন, চেয়ারম্যান-এমডি পদে প্রার্থিতা নিশ্চিত হলে ওই ব্যক্তিকে বলা হতো, তার পক্ষে ঘুষের অর্থ পরিশোধকারী গ্রুপকে ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে বড় অংকের অর্থ তুলে নেওয়ার সুযোগ করে দিতেই হবে।

 

ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও শেখ রেহানার হাত ছিল। তার কথা মেনে চলবেন, এমন দুই-তিনজনকে সালমান-নাফিজ পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়াতেন। নিয়োগকৃত প্রার্থীদের দেওয়া হতো বিশেষ ক্ষমতা। তারা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ব্যাপক প্রভাব প্রয়োগ করতেন। বড় ঋণের প্রস্তাব পাস করিয়ে দিলে তারাও ঘুষের একটি অংশ পকেটে পুরতে পারতেন। সাধারণত আওয়ামী পেশাজীবী বা রাজনৈতিক নেতারাই ব্যাংকগুলোয় প্রভাবশালী পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেতেন। তাদের কাজ ছিল, পর্ষদকে নিয়ন্ত্রণ করা। এভাবেই ঋণের নামে লাখো কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে। ‘বিশেষ আশীর্বাদ’ ছাড়া যারা পরিচালক হিসেবে এসব ব্যাংকে নিয়োগ পেতেন, তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ ছিল কেবল পর্ষদ সভার কোরাম পূর্ণ করার মধ্যে। সৎ পরিচালক হিসেবে পরিচিতরা কোনোভাবেই শক্ত অবস্থান নিয়ে থাকতে পারতেন না।

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই ছিল খেলাপি। সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এসবের বাইরে আরও অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকার ঋণ এখন মেয়াদোত্তীর্ণ। খেলাপি ঋণের প্রভাবে পাঁচ ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতি এতটাই তীব্র হয়ে উঠছে, প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখা হলে সব ব্যাংক লোকসানের মুখ দেখবে। উল্লেখ্য, প্রভিশন বা সঞ্চিতির মানে হলো পর্যাপ্ত মুনাফা। বিশেষ উদ্দেশ্যে এর অংশ বিশেষ দিয়ে যে তহবিল সৃষ্টি করা হয় সেটিই প্রভিশন বা সঞ্চিতি।

 

২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে পরের বছর সরকার গঠনের পর থেকে টাকা সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠনের পর প্রত্যেকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগ হয় আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নির্ধারক পর্যায় থেকে। নেপথ্যে ছিলেন শেখ রেহানা। নিয়োগ পাওয়া সবাই দলীয় বিবেচনায় বড় বড় পদ পেয়েছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শেখ আবদুল হাই বাচ্চু, তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে। সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয় কাজী বাহারুল ইসলামকে। জনতা, অগ্রণী, রূপালী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়ারাও আওয়ামী লীগ মদদপুষ্ট ছিলেন।

 

এই ব্যাংকগুলোয় পরিচালক ও এমডি পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তারা সরাসরি আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা ও পত্রিকার সম্পাদকও। এরপর থেকেই ব্যাংকগুলোয় শুরু হয় একের পর এক দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি।

 

নাম না প্রকাশের শর্তে সোনালী ব্যাংকের এক সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, তিনি ২০১৬-১৯ মেয়াদে সোনালী ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০১৯ সালে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে পরবর্তী তিন বছরের জন্য রূপালী ব্যাংকের এমডি করা হয়। বর্তমানে তিনি আরেকটি ব্যাংকের পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান। সোনালী ব্যাংক থেকে তাকে সরিয়ে নেওয়ার পর পুনর্নিয়োগ পাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এর বিনিময় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০০ কোটি টাকা।

 

তিনি জানান, তাকে সোনালী ব্যাংকে ফিরতে ১০০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দিলেও কোনো অর্থ খরচ করতে হবে না বলে জানায় সরকার সংশ্লিষ্টরা। তার পক্ষে অন্য কেউ এ অর্থ পরিশোধ করবে, তবে ওই পক্ষকে ব্যাংক থেকে লোন নেওয়ার জন্য অনৈতিক ছাড় দিতে হবে। কিন্তু তিনি রাজি হননি। এরপর খড়্গ পড়ে তার ওপর। সোনালী থেকে রূপালী ব্যাংকে সরিয়ে নেওয়া হয় তাকে।

 

আর্থিক খাতের এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা দাবি করে বলেছেন, তিনি দুটি ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এস আলম বা সালমান এফ রহমানকে কোনো অনৈতিক সুবিধা নিতে দেননি। যে কারণে তাদের চক্ষুশূল হতে হয়েছে তাকে।

 

শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও শেখ রেহানার ‘তোষামোদকারী’ হিসেবে বিবেচিত সালমান এফ রহমান ব্যাংকের বড় পদে নিয়োগের ব্যাপারে নিজেও বিশাল আকারের সুবিধা নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চারটি ব্যাংকে চেয়ারম্যান ও এমডি নিয়োগে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তার প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। শুধু জনতা ব্যাংকেই বেক্সিমকোর ঋণের স্থিতি এখন ২৬ হাজার কোটি টাকা।

 

শুধু সালমানই যে সুবিধা নিয়েছেন তা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন তার ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমানও। উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনের যে বাড়িতে শেখ রেহানা বসবাস করতেন সেটির মালিক শায়ান। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের পর্ষদেও ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক পর্ষদ থেকেও।

 

রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক, মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তিও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে বাড়ি উপহার নিয়েছেন এমন অভিযোগ উঠেছে। ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের (ট্রেজারি) অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার (ইকোনমিক সেক্রেটারি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন টিউলিপ।

 

মন্ত্রী হিসেবে তিনি আবার ব্রিটেনের আর্থিক খাতের অপরাধ-দুর্নীতি বন্ধের দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু নিজে দুর্নীতির বাইরে নন। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে বিনামূল্যে পাওয়া একাধিক অ্যাপার্টমেন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। তিনি যাদের কাছ থেকে ‘উপহার’ হিসেবে ফ্ল্যাট নিয়েছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন বা তার খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ। এদের মধ্যে দুজনের নাম পাওয়া যায়, একজন আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জাফর উল্লাহ অপরজন আবদুল মোতালিফ নামে একজন আবাসন ব্যবসায়ী। তিনিও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ। এ নিয়ে জল কম ঘোলা হচ্ছে না। তাকে বরখাস্তের দাবি তুলেছেন বিরোধী দলীয় নেতারা।

 

এ ছাড়া ২০১৩ সালে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিতে টিউলিপ মধ্যস্থতা করেছেন এমন অভিযোগও রয়েছে। গত ১৭ ডিসেম্বর ৯ প্রকল্পে ৮০ হাজার কোটি টাকা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শেখ রেহানা ও টিউলিপের বিরুদ্ধে অসুন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। একই অভিযোগে অভিযুক্ত শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও।

 

ব্যাংক খাতে শেখ রেহানার যে দুর্নীতির অভিযোগ মিলছে, সেখানে তার সঙ্গে মো. আতাউর রহমান প্রধানেরও নাম শোনা যায়। তিনি ২০১২ সালের পর তিন বছর সোনালী ব্যাংক ইউকে লিমিটেডের শীর্ষ নির্বাহীর দায়িত্বে ছিলেন। সে সময় নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও ব্যাংক পরিচালনায় ব্যর্থ হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ব্রিটেনে থাকা বাংলাদেশি ব্যাংকটি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার পান তিনি। ২০১৬ সালে তাকে রূপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে নিয়োগ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। তিন বছর পর তাকে সোনালী ব্যাংকের এমডি করা হয়।

 

অভিযোগ আছে, সোনালী ব্যাংক ইউকের শীর্ষ নির্বাহী থাকা অবস্থায় শেখ রেহানার ছায়াতলে আসেন আতাউর। তিনি বাংলাদেশ থেকে রেহানাকে টাকা পাচারে সহযোগিতা করতেন। সেই সম্পর্কের কারণে তিনি শেখ হাসিনা কর্তৃক বাংলাদেশের দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শীর্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন। অবসরের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করেন আতাউর। ২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি লালমনিরহাট-১ আসনে প্রার্থী হয়েছিলেন। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর থেকে আতাউর রহমান প্রধানও পলাতক বলে জানা গেছে।

 

‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারির মতো বড় ঘটনাতেও শেখ রেহানার ‘হাত রয়েছে’ বলে অভিযোগ আছে। সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছিল গ্রুপটি। রয়েছে ছোট-বড় আরও ঋণ কেলেঙ্কারি ঘটনা। সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা। এটি বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৬ শতাংশ। তবে এ মুহূর্তে সোনালীর আর্থিক সূচকগুলো কিছুটা ভালো।

 

অগ্রণী ব্যাংকের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নেই। আগে এ ব্যাংকটি থেকে অন্য ব্যাংকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিত। এখন ব্যাংকটির সঞ্চিতি ও মূলধন ঘাটতির পরিমাণও দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে লেনদেন মেটানোর জন্য এখন বাজার থেকে অর্থ ধার নিচ্ছে ব্যাংকটি। নথিপত্র থেকে জানা যায়, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ছিল ৭৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। এ ঋণের মধ্যে ২৬ হাজার ৮৯২ কোটি টাকাই ছিল খেলাপি, যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটি ৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপনও করেছে। ওই সময় পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণও ছিল ৪ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার বেশি। আর ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সে হিসাবে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশই এখন খেলাপি।

 

২০১৬ সালের আগস্ট থেকে টানা সাত বছর এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন এক কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে ঘুষের বিনিময়ে প্রভাবশালী গ্রাহকদের ঋণ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। নাফিজ সরাফাতের মধ্যস্থতায় শেখ রেহানার আস্থাভাজন হন তিনি।

 

গত ১৫ বছরে একইভাবে লুটপাটের শিকার হয়েছে জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং আলোচিত বেসিক ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা। এটি ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬১ শতাংশ। যদিও ব্যাংকটির পর্ষদে উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে, প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ এখন প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৭৫ শতাংশেরও বেশি এখন খেলাপি। পরিস্থিতি এমন, যেকোনো সময় ব্যাংকটি সিআরআর-এসএলআর ঘাটতিতে পড়ে যেতে পারে।

 

জনতা ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি ৯৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এর অর্ধেকেরও বেশি তথা ৪৯ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকাই নিয়েছে মাত্র পাঁচটি গ্রুপ বা পরিবার। এর মধ্যে এককভাবে সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়েছে ২৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এছাড়া এস আলম গ্রুপ ১০ হাজার ১৭১ কোটি টাকা, এননটেক্স গ্রুপ ৭ হাজার ৭৭৪ কোটি, ক্রিসেন্ট গ্রুপ ৩ হাজার ৮০৭ কোটি ও ওরিয়ন গ্রুপ ৩ হাজার ১১ কোটি টাকা নিয়েছে।

 

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই সময় পর্যন্ত রূপালী ব্যাংক ২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতেও ছিল। আর বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৬৫ শতাংশ এখন খেলাপি, যার পরিমাণ সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। গত ১১ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ ব্যাংকটির নিট লোকসান প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটিকে বাঁচানোর জন্য সরকার বাজেট থেকে ৩ হাজার ৩৯০ কোটি টাকার মূলধন জোগান দিয়েছে। তারপরও কাজ হয়নি। ব্যাংকটি এখনো প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

 

একজন সাবেক ব্যাংকার বলছিলেন, গত দেড় দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী ছিল শেখ পরিবার। কখনো বেনামি ঋণের নামে সরাসরি, আবার কখনো পরোক্ষভাবে সুবিধা নিয়েছে এ পরিবারটি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাই এসব ঋণ নিয়েছেন, এবং ১৫-২০ শতাংশ বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন। ঋণের নামে রাষ্ট্রের এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে লাখো কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন তারা। সূত্র : বাংলানিউজ২৪


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় সিলেটে কোরআন খতম ও দোয়া

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় সিলেটে কোরআন খতম ও দোয়া

অধ্যক্ষ হয়ে ভাগ্য বদলে যায় অনুতোষ কুমারের

অধ্যক্ষ হয়ে ভাগ্য বদলে যায় অনুতোষ কুমারের

দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে আন্দোলনে নামা হবে : কর্নেল অলি

দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা না করলে আন্দোলনে নামা হবে : কর্নেল অলি

ভুল এমনি এমনি হয় না, এর পেছনে কারো না কারো হাত থাকে : ইসি

ভুল এমনি এমনি হয় না, এর পেছনে কারো না কারো হাত থাকে : ইসি

সিলেটকে উড়িয়ে জয়ের ধারায় চট্টগ্রাম

সিলেটকে উড়িয়ে জয়ের ধারায় চট্টগ্রাম

ঈশ্বরগঞ্জে গলায় ফাঁস দিয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মৃত্যু

ঈশ্বরগঞ্জে গলায় ফাঁস দিয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মৃত্যু

সচিবালয়ের পথে জবির অনশনকারী শিক্ষার্থীরা

সচিবালয়ের পথে জবির অনশনকারী শিক্ষার্থীরা

হাজীগঞ্জে ছেলের ঘুষিতে বাবার মৃত্যুর অভিযোগ

হাজীগঞ্জে ছেলের ঘুষিতে বাবার মৃত্যুর অভিযোগ

ফরিদপুরে যুবককে কুপিয়ে ও চোখ উপড়ে হত্যা: চেয়ারম্যানকে আসামি করে মামলা

ফরিদপুরে যুবককে কুপিয়ে ও চোখ উপড়ে হত্যা: চেয়ারম্যানকে আসামি করে মামলা

নরকিয়া ও এনগিডিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দ. আফ্রিকা দল

নরকিয়া ও এনগিডিকে নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দ. আফ্রিকা দল

বান্দরবানে দূর্বৃত্তের গুলিতে মার্মা নারী আহত

বান্দরবানে দূর্বৃত্তের গুলিতে মার্মা নারী আহত

‘বিতর্ক ওঠায়’ পিএসসির ৬ সদস্যের নিয়োগ বাতিল

‘বিতর্ক ওঠায়’ পিএসসির ৬ সদস্যের নিয়োগ বাতিল

পুলিশকে নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে : পুলিশ সুপার

পুলিশকে নিষ্ঠা, পেশাদারিত্ব ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে : পুলিশ সুপার

কুয়াকাটায় জেলেদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৩

কুয়াকাটায় জেলেদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৩

বাংলাদেশে থেকে ওরা পালিয়েছে-  আল্লামা তারেক মনোয়ার

বাংলাদেশে থেকে ওরা পালিয়েছে- আল্লামা তারেক মনোয়ার

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সমস্যা সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ চাই

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সমস্যা সমাধানে কঠোর পদক্ষেপ চাই

"স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ: আপামর জনতার ত্যাগের ফসল"

"স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশ: আপামর জনতার ত্যাগের ফসল"

পূর্ব ইউক্রেনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাশিয়া

পূর্ব ইউক্রেনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাশিয়া

কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চলে সারের বাফার গুদাম করা প্রয়োজন মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চলে সারের বাফার গুদাম করা প্রয়োজন মহাপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর

তাইম ও হৃদয় হত্যাকাণ্ডে দুই পুলিশ সদস্যকে ২০ জানুয়ারি ট্রাইবুনালে হাজিরের নির্দেশ

তাইম ও হৃদয় হত্যাকাণ্ডে দুই পুলিশ সদস্যকে ২০ জানুয়ারি ট্রাইবুনালে হাজিরের নির্দেশ